Science

প্রায় একশত বছর আগে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে তাত্ত্বিকভাবে স্থান-কাল বাঁকিয়ে দেওয়া যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কথা বলেছিলেন, সে ‘মহাকর্ষীয় তরঙ্গ’ যে শনাক্ত করা কখনো সম্ভব হবে তা সম্পর্কে তিনি সম্ভবত ভাবেনই নি । তবে, ২০১৫ সালে রাইনার ওয়িস, রোনাল্ড ড্রেভার , ব্যারি ব্যরিশ এবং কিপ থর্নের নেতৃত্বে লাইগো প্রথমবারের মত এই তরঙ্গ সনাক্ত করেন । এই তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ায় মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে জনপ্রিয় বিগ ব্যাং তত্ত্ব আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবী থেকে শত কোটি আলোকবর্ষ দূরে সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ ভারী দু’টি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ থেকে সৃষ্টি এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ(গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েব) শনাক্ত করা হয়েছে।আলোক বিকিরণের কোয়ান্টামকে যেমন ফোটন বলা হয়, তেমনি মহাকর্ষীয় বিকিরণের কোয়ান্টামকে বলা হয় গ্রাভিটন। পুকুরে ঢিল ফেললে যেমন একটা তরঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে তার পাড়ে পৌঁছে যায়, তেমনই এই বিশ্বে এখনো ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে।
রোনাল্ড ড্রেভার মারা যাওয়ায় নোবেল কমিটি রাইনার ওয়িস,ব্যারি ব্যরিশ এবং কিপ থর্নকে গত বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেন । ২০১৭ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলের ১/৪ অংশের বিজিতা কিপ থর্ন বলেন , " আমি আইনস্টাইনের অনেক পরে জন্মেছি, আমি যে যুগে বাস করছি সেখানে লেজার, বড় বড় সুপার কম্পিউটার সহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির সনাক্তকারী যন্ত্র আছে। আইনস্টাইনের তাত্ত্বিক মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার মাধ্যমে এই বিষয় নিয়ে সংশয়বাদীদের "কিন্তুর" অবসান হয়েছে । আইনস্টাইনের সময়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সম্ভাবনাপন্ন উৎস সম্পর্কে কেউ জ্ঞাত ছিল না। এখন আমরা জানি নিউট্রন নক্ষত্র,ব্লাকহোল হল মহাবিশ্বের সবচাইতে সুলভ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎস। ...... সবে তো শুরু । গ্যালিলিও যেমন টেলিস্কোপ আবিস্কারের মাধ্যমে জ্যোতির্বিদ্যায় রেনেসাঁ জাগ্রত করে গিয়েছিলেন যার ফলশ্রুতিতে জ্যোতির্বিদ্যা আজ এতদুর পৌঁছেছে , ঠিক তেমনিভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তের মাধ্যমে বেতার জ্যোতির্বিদ্যাসহ তড়িৎচৌম্বকীয় জ্যোতির্বিদ্যায় নব অধ্যায়ের সুচনা হল । শুধু বাইনারি ব্লাকহোলের সংঘর্ষ না কিছুদিনের মধ্যে হয়ত নিউট্রন নক্ষত্র-নিউট্রন নক্ষত্র বা ব্লাকহোল-নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষের আলামত পাব।এর সাথে প্রযুক্তির কিছুটা উন্নয়নে আমরা এদের সংঘর্ষ দেখতে পারব। ব্লাকহোল বা নিউট্রন নক্ষত্র কিভাবে একে অপরকে ধংসের লীলাখেলায় মত্ত তা দেখতে পাব । গালিলিও যেমন টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রথমবারের মত বৃহস্পতির উপগ্রহগুলি পর্যবেক্ষণ করেন তেমনি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে ব্লাকহোল,মেজার, নিউট্রন নক্ষত্র বা পালসার দেখা সম্ভব হবে । ...... এটি অনেক বিজ্ঞানি ও কলাকুশলীর কয়েক দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল । আমি বেশি খুশি হতাম যদি নোবেল কমিটি সংস্থা হিসেবে পুরো লাইগো প্রোজেক্টকে পুরুস্কৃত করত , শুধু মাত্র ওয়িস,ব্যারি বা আমি না , বরং পুরো লাইগো টিম এই পুরস্কারের যোগ্য অধিকারি । "
কিপ স্টিফেন থর্ন একজন মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি মহাকর্ষ পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন টিভিসিরিজ সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কারনে সুপরিচিত। তিনি কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের শিক্ষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে নিরলস কাজ করে গেছেন। এমনকি তিনি, দীর্ঘকাল স্টিফেন হকিং ও কার্ল স্যেগানের বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। তিনি ২০০৯ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলোজির(ক্যালটেক) তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ফাইনম্যান অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের জ্যোতিঃপদার্থবৈজ্ঞানিক প্রয়োগ বিষয়ে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত এক পণ্ডিত। তিনি বিজ্ঞান জন্যপ্রিয়করন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দিকনির্দেশ দিয়ে থাকেন। ক্রিস্টোফার নোল্যানের ইন্টারস্টেলার চলচ্চিত্রের জন্য তিনি বিগ্যান পরামর্শক ও প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। লাইগোতে তিনি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি,আকার ও শক্তি নিয়ে কাজ করেন । লাইগোর বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টের যাচায়সহ গানিতিক মডেল উপস্থাপন করেন এবং লাইগো ও ভার্গো সনাক্তকারী যন্ত্রগুলির সিগন্যালের পরীক্ষা ও সম্ভাবনা যাচায় করেন । কাজেই কোন সিগন্যাল মহাকর্ষীয় তরঙ্গই কিনা তা সবার আগে তিনি(তার গানিতিক মডেল ব্যাখ্যার দলসহ) বুঝতে পারেন । আর তরঙ্গের শক্তি ও আকৃতি অনুযায়ী উৎসের প্রকৃতি ও দূরত্ব নিরুপন করেন ।
কিপ থর্ন উটাহ তে ১৯৪০ সালের পহেলা জুনে জন্মগ্রহন করেন । তার বাবা মা ছিলেন যথাক্রমে উটাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির কৃষিবিদ্যা ও অর্থনীতির অধ্যাপক । তার বাবা মা মর্মর খ্রিস্টান হওয়ার দরুন শিশুবয়সে তাকে The Church of Jesus Christ of Latter-day Saints এ পাঠানো হয় । কিন্তু সংশয়মনা থর্ন চার্চের ধর্মীয় শিক্ষা
একদমই পছন্দ করতেন না । তিনি ছোট থেকেই বিজ্ঞানের পুজারি ও নিজেকে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বলে প্রকাশ করতেন। তার ৪ ভাইবোনের মধ্যে দুইজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । তাই পারিবারিক ধারায় বেরে উঠার জন্য থর্নও স্বাভাবিকভাবেই ছোটবেলায় শিক্ষকতাকে বেছে নেন।
থর্ন খুব অল্প বয়সে স্কুলের গণ্ডি পাড়ি দিয়ে ক্যালটেকে ভর্তি হন । ১৯৬২ সালে ক্যালটেক থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন অরার পরে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন । এরপরে, জন হুইলারের অধিনে কয়েকটি ডক্টোরাল থিসিস সম্পন্ন করেন । ১৯৬৭ সালে ক্যালটেকের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সহকারি অধ্যাপক হিসেবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ ফ্যাইনম্যান অধ্যাপকের পদে আসীন হন । ২০০৯ সালে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক লেখনী ও সিনেমা তৈরির জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সময়ের অপ্রতুলতার জন্য পদটি ছেড়ে দেন । এই সময়ের মধ্যে তার অধীনে প্রায় ৫০ জন পিএইচডি সপন্ন করেছেন । তিনি মহাকর্ষ বিষয়ক পদার্থবিজ্ঞান এবং বিশ্বতত্ত্বসহ জ্যোতির্বিজ্ঞানের মৌলিক কিছু তত্ত্ব প্রমান ও ধারনার জন্য বিখ্যাত। ১৯৯৯ সালে তিনি একবিংশ শতাব্দীতে প্রমান হতে পারে এমন কতগুলো মৌলিক তত্ত্ব দার করান, এর মধ্যে কয়েকটি হল,
# মহাবিশ্বের কি এমন কোন অজানা স্থান আছে, যেখানে ডার্ক ম্যাটার বা ব্লাকহোলেরা রাজত্ব করে ?
# আমরা কি স্থান-কালের বক্রতাসহ বিভিন্ন বিকিরন ব্যাখ্যার মাধ্যমে কখনো মহাবিশ্বের জন্ম বা এর অজানা "dark side" পর্যবেক্ষণ করতে পারব?
# একবিংশ শতাব্দীতে কি কণাদের বিভিন্ন বৈশিষ্টের দ্বারা বড় স্কেলের বস্তুদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে ?
তিনি বিবিসি,পিবিএসের বিজ্ঞানমুলক অনুস্থানসহ বিভিন্ন দূরদর্শনমুলক অনুষ্ঠানে ব্লাকহোল,বিকিরন,মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, ওয়ার্মহোল, বিগ ব্যাং সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বেশ সুপরিচিত । মুলত আপেক্ষিকতত্ত্ব জনিত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি টাইমট্রাভেল বিষয়ের একজন দক্ষ বিজ্ঞানি , ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে যে শুধু স্থান না বরং সময়েও ভ্রমন সম্ভব তা তিনি তাত্ত্বিকভাবে প্রমান করেন এবং জনসাধারণের মাঝে প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়াও তিনি নিউট্রন নক্ষত্র সম্বলিত লাল অধিদানব নক্ষত্র, ব্লাকহোলের এনট্রপি ব্যাখ্যা, অস্থায়ী ওয়ার্মহোল , এক্সোটিক ম্যাটার, ব্লাকহোল-হোয়াইটহোলের একক সিঙ্গুল্যারিটি সহ বহু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । ইন্টারস্টেলার মুভির ব্লাকহোল স্যিমুলেশন, টেসের‍্যাক্টের ঘটনাবালি ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনের প্রধান দায়িত্বে তিনি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের বিষয়ে একটি বাজি ধরেছিলেন স্টিফেন হকিং। বাজিতে তাঁর পক্ষে ছিলেন কিপ থোর্ন এবং বিপক্ষে ছিলেন জন প্রেসকিল। পদার্থবিজ্ঞানেরইতিহাসে এই বাজিটি Thorne–Hawking–Preskill bet নামে পরিচিত।

Comments

Popular Posts